রাজনীতি ডেস্ক:-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় লাগাম দেওয়া, মেয়াদে সীমা টানার মত নানা পদক্ষেপ, বয়স কমিয়ে তরুণদের সংসদে আসার সুযোগ দেওয়াসহ বড় পরিসরে সংস্কারের প্রস্তাব এসেছে; একইসঙ্গে বিদ্যমান সংবিধানের মূলস্তম্ভের নানা জায়গাতেও রদবদলের সুপারিশ করা হয়েছে।
পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনা, জাতীয় সংসদ, নির্বাচনসহ বহু মৌলিক জায়গায় পরিবর্তনের সুপারিশ এসেছে রাষ্ট্র মেরামতে প্রথম ধাপে গঠিত ছয় সংস্কার কমিশনের মধ্যে চারটির কাছ থেকে।
এসব প্রতিবেদন হাতে পেয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলছেন, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সেগুলো নিয়ে সামনের দিকে এগোতে চান তিনি।
বুধবার কমিশন প্রধানদের কাছ থেকে বিশদ প্রতিবেদন পাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের রোডম্যাপ তৈরিতে এ চার কমিশনকে আরও এক মাস সময় দেওয়া হবে।
রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারে যে ১১টি কমিশন গঠন করেছে সরকার, সেগুলোর মধ্যে চূড়ান্ত হওয়া চারটির প্রতিবেদনে সংবিধান, সংসদ, নির্বাচন ব্যবস্থায় বিস্তর পরিবর্তনের মাধ্যমে সংস্কারকে এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে সংস্কারের চেয়ে দ্রুত নির্বাচন আয়োজনে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, তখন সব কিছু আমূল পাল্টে দেওয়া এসব সংস্কার কার্যক্রম কতটা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে সন্দিহান বিশ্লেষকরা।
তবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস বলছেন, প্রয়োজনীয় ও আবশ্যকীয় কিছু সংস্কার তিনি নির্বাচন আয়োজনের আগে শেষ করতে চান। যেগুলো থেকে যাবে, সেগুলো ভবিষ্যতের জন্য জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে রেখে যেতে চান তিনি।
বুধবার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধানরা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে প্রতিবেদন তুলে দেন।
এরপর বক্তৃতায় তিনি বলেন, “সব জিনিস যেহেতু নির্বাচনের আগে সম্ভব হবে না, কাজেই কিছু জিনিস থেকে যাবে। সেটা চার্টারের (গণঅভ্যুত্থান সনদ) আঙ্গিকে যেন আমরা এগিয়ে যেতে পারি।
“এটাকে সামনে রেখে আমাদের এগোতে হবে। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কাজে এগুলোকে নতুন করে পরিশীলিত করে জাতির সামনে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে সবাই একমত হতে পারি।”
২০২৪ সালে জুলাই-অগাস্টে প্রবল আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এর তিন দিন পর অন্তর্বর্তী সরকার দেশের হাল ধরে। তুমুল সেই গণ আন্দোলনের দাবি পূরণে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে দুই ধাপে মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে।
এর মধ্যে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে গঠন করা হয় নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন।
এর মধ্যে বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। অন্য চারটি কমিশন বুধবার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
প্রথম ধাপে জমা পড়া প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে সংবিধান সংস্কারে দেওয়া প্রস্তাবগুলো এসেছে আলোচনার অগ্রভাবে।
১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে সংবিধানের মোট পাঁচটি মূলনীতির পাশাপাশি বাংলায় দেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ থেকে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ করার মত সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তির সর্বোচ্চ দুইবার থাকার বিধানের পাশাপাশি সংসদ ও রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ চার বছর এবং আইনসভাকে ‘জাতীয় সংসদ’ ও ‘সেনেট’ নামে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট করার সুপারিশও এসেছে এ কমিশনের তরফে। সংসদের সদস্য সংখ্যাও ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৪০০ করার সুপারিশও আছে প্রস্তাবে।
দেশের শীর্ষ পদগুলোতে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের সুপারিশও করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতার পাশাপাশি সংসদের দুই কক্ষের স্পিকার ও বিরোধী দল থেকে আসা দুই ডেপুটি স্পিকার এবং সরকার ও বিরোধী দলের বাইরের একজন সংসদ সদস্য থাকবেন এ কাউন্সিলে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পাশাপাশি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব সাংবিধানিক কাউন্সিলের জন্য রাখার সুপারিশ করা হয়েছে সংস্কার প্রস্তাবে।
ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সংবিধানের অঙ্গীকার, দুর্নীতি বিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়ন, ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা ও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিলের প্রস্তাবসহ ৪৭ দফা সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশন।
বেআইনি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও আসামিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা চেয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। র্যাবের প্রয়োজনীয়তা পুনর্মূল্যায়নের সুপারিশও করা হয়েছে।
এছাড়া বাহিনী সংস্কারের জন্য ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে এ কমিশন।